ভ্রমণ বিষয়ক লেখা

হৃদয়ের টানে

হৃদয়ের টানে – 1

ইনক্রেডিবল এই ভূ-ভারতে বেড়াতে যাওয়ার কয় কোটি জায়গা আছে? সংখ্যাটা ক্রমবর্ধমান, আর আমার পরিধিটা ক্রমহ্রাসমান। হ্যাঁ, আমরা বছর বছর ডুয়ার্স ছাড়া আর কোত্থাও বেড়াতে যাইনা। প্রতিবার যখনই বেড়ানোর প্ল্যান প্রোগ্রাম হয়, আমরা মুখে মুখে অরুণাচল থেকে আমেদাবাদ ঘুরে, শেষে এক রাতপ্রহরে কাঞ্চনকন্যা বা দার্জিলিং মেলে চেপে বসি। বছর চারেক আগে বোধয় একবার কোদাইকানাল ইত্যাদিতে Giran, যে কিনা আমার দিনযাপনের সাথী, জোর করে বেড়াতে নিয়ে গেছিল, কিন্তু আমার একদম ভাল্লাগেনি। কোনোক্রমে দিন পাঁচেক কাটিয়ে যখন জেট এয়ারওয়েজের ছোট্ট সিটের ফিরতি ফ্লাইটে উঠলাম, ওই ফিতে বাঁধা বন্ধনেও ভারি মুক্ত লেগেছিল….. এই চার বছরে লাদাখ, অরুণাচল, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ঝাড়খন্ড এই স অ অ অ ব ক’টি জায়গায় প্রায় বুকিং করেও সেগুলোকে ক্যান্সেল করে ফের আমরা ডুয়ার্সগামী হয়েছি ; এই গল্পটা বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করুন Avik কে, যার চোখে ধূলো মেরে আমরা বারংবার ভেগে গেছি ওই জঙ্গলপাহাড়ে….
                                              ebongaranya.com
এবারও, যথারীতি নো ব্যতিক্রম। অভিক টিকিট কাটলো উদয়পুরের, আমরা কাট মারলাম উত্তরে। অর্ধেক চাঁদের রাতে ট্রেনের ডিব্বায় সাইড লোয়ারে জেগে কাটানোর যে অনুভূতি, সে তো আগেই লিখে সেরেছি…. ইদানীং পথে প্রবাসে বাজারে বইয়ের দোকানে এমনকি কোলকাতার রাস্তাতেও ঝারি মারার লোকজনের এত্ত অভাব…. সেই চোখই খুঁজে পাওয়া যায়না আর…. ট্রেনেও তার ব্যতিক্রম হলনা। অতএব চাঁদের সাথে রাতভর চাঁদমারি খেলে ভোরবেলা নামা গেল এন যে পি স্টেশনে।
বাইরে বেরোতেই দু-হাত মেলে যিনি সরাসরি হৃদয়ে টেনে নিলেন, তার নাম সুদেব’দা। সুদেবদা আর আমি একই বয়সী, তাও ও আমাকে বৌদি, আর আমি ওকে দাদা বলে ডাকি। চার বছর আগে, যেবার প্রথম লাটাগুড়ি গেলাম, সেবারই ওর সাথে পরিচয়। সত্যি বলতে কি, ওই যে ও স্টেশনে এসে ওরম কান অব্দি হেসে গিরনকে দাদা বলে জড়িয়ে ধরে, ওইটুকুতেই মনে হয়, গোটা ডুয়ার্সটা যেন এসে ঝাপটে পড়ে জড়িয়ে ধরল আমাদের। এই জলপাইগুড়িতে মানুষের আন্তরিকতার প্রথম পাঠ, সুদেব বসাক। যে আমাদের আসার আগের দিন রাত জেগে বসে গিরনের জন্য সন্দেশ বানায়, আমার মা-বাবার জন্য বাজার ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে মিঠাপাতি পান, বোরোলি মাছ, ঢেঁকিশাক, গাছের মোচা এইসব নিয়ে আসে। Rinki, ওর বউ, আমি পায়েস খেতে ভালোবাসি শুনে অসুস্থ শরীরে সদ্যজাত দুই ছেলেকে কোলে নিয়ে আমার জন্য পায়েস বানায়….। এই লাইনগুলো যখন লিখছি, চোখে জল আসছে। কি-ই বা সম্পর্ক ওদের সাথে! কতটুকু দাঁড়াতে পেরেছি কোনোদিন আপদে বিপদে ওদের পাশে!! এসব কিচ্ছু ভাবেনা ওরা…. কেবল ভালোবাসে… কেবলই ভালোবাসে। প্রত্যেকবার, আলিপুরদুয়ার জংশনে ছাড়তে আসার সময়ে সুদেবদার চোখে জল দেখি…. এইসব আবেগ……. শব্দ হারায় এসবের কাছে।
যাই হোক, তো সেই সুদেবদা গাড়িতে চড়িয়ে আমাদের পাহাড়ে চড়াতে শুরু করল। প্রথম ডেস্টিনেশন, লেপচাজগৎ। কিছু এরকমও প্রেমের সম্পর্ক থাকে, যেখানে আপনি ঘ্যানঘ্যান করেই যান, আর উল্টোদিকের জন আপনাকে পীড়া দিয়ে বেশ মজা দ্যাখেন। পাহাড়ের সাথে আমার সেরকম ষাঁড়াষাঁড়ি ‘সম্পক্ক’। পাহাড় যত রাউন্ড এ্যান্ড রাউন্ড মারতে থাকে, আমার ভিতরের নাড়িভুঁড়িগুলো তত পাকাতে থাকে। তো যাই হোক, সেইসব সিপাহি বিদ্রোহকে যাত্রাপথে মারকাটারি দৃশ্যাবলীর ধামা চাপা দিয়ে এগোনো গেল। যাওয়ার পথেই ‘তিনি’ দেখা দিলেন…. তুষারগৌরকান্তি…. সত্যি বলতে কি, দীইইইইইর্ঘ অদর্শনের পর যশোয়ন্তের গল্পের সেই ডাকাতকে তার প্রেয়সী ঝুমরিতালাইয়া দেখতে পেল যখন, যেমন ঝামলে ঝাপটে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল, আমারও তেমন হাল হল। কোনোমতে গাড়ি থামতেই দরজা খুলে এক দৌড়…. সামনেই খাদ, দেখতেই পাচ্ছিনা যেন এমনই বাং কানা। সুদেবদাই এসে আটকালো, ‘বৌদি, কর কি! মরবা নাকি!’ তাকে আমি কি করে বোঝাই, প্রথম দর্শনেই সেই গৌরকান্তি আমায় মাইর‍্যালা রে…..
তারপর……..
যে কথা এখানে বলে নেওয়া ভীষণ জরুরি, এই তারপর সিরিজ দিয়ে একটা গোটা বেড়ানো-গল্প যে লিখে ফেলা যায়, সেই আইডিয়া বা অনুপ্রেরণাটা সম্পূর্ণ নিয়ে ফেললাম তিয়াষ মুখোপাধ্যায়-এর কাছে। তিয়াষ,, ঋণ রইল আপনার কাছে।
তবে হ্যাঁ, উনি যতটা নিয়মিত এই শৃঙখলা রেখেছেন, আমি যে ততটা রাখবো, এমন কথা মোটেই দিতে পারতেছিনি। আমার এই আটভাট প্রলাপে যাঁরা মনোযোগ দিয়ে সময় নষ্ট করবেন বলে ভাবছেন…… তাঁরা….
লেখক : বর্ষা চক্রবর্তী 
barshaguria@gmail.com
হৃদয়ের টানে – 2
তারপর…..
তারপর ক্যামেরার ব্যাগটাকে বছরখানেকের কর্মদিবসের পর ভার বহনের থেকে খানিক ছুটি দিয়ে পটপটাপট শাটারের ছোটাছুটি। কেবলমাত্র ডুয়ার্সে এলেই ক্যামেরা আর লেন্সগুলোর খানিক কাজ পড়ে, বাকি বারো মাস ওদের ছুটি। ছুটি, কারণ, আমি ছবি তুলতে পারিনা। সোজা কথা। একটা মুহূর্তকে দেখা, এবং সেটাকে অনুরূপ যন্ত্রে ধরতে যতটা তুখোড় শিল্পী হতে হয়, যতটা সেই শিল্পটাকে ভালোবাসতে হয়, যত্ন করতে হয়, তার সিকিভাগও আমার মধ্যে নেই। যখন প্রথম ক্যামেরা কিনি, দাদামশাই একটা ভারি সুন্দর কথা বলেছিল, ‘ছবি যেন কেবল জলছাপ না হয়, এমন ছবিই তুলবে, যে ছবি নিজেই একটা গল্প বলে।’ তেমন ছবি কোনোদিন আমি যন্ত্রে ধরতে পারিনি। অথচ ‘ওহ লমহে কি কুঁয়ে মে রোজ ঝাঁকতে হ্যায়…’ ☺……
শিবের গীতের মুদ্রাদোষ… যাই হোক, তো সেই প্রেমিকপ্রবরকে সঙ্গে নিয়েই ফের আমাদের যাত্রা শুরু হল। আমরাও এগোই, তিনিও কাছে আসতে থাকেন। কেবল কাছেই আসেন না, এক একটা বাঁক পেরোই, খানিক দূরে যান, আবার একটু একটু করে শল্কমোচনের মতন করে এগিয়ে আসেন। আহা….. কারোর যদি প্রেমের পাঠ-প্রকরণ জানার ইচ্ছে থাকে, তিনি জীবনে একবার অন্তত হিমালয় কে ভালোবেসে দেখুন….. কিংবা রাজর্ষি বসুকে। না না, বুদ্ধদেব গুহ’কে। না না, রবীন্দ্রনাথ… না তার চেয়ে বরং বাংলা সাহিত্য…. সাহিত্য………
ফের হারিয়ে ফেলছি না..? আচ্ছা, এবার একদম ট্র‍্যাক ছেড়ে বেরোবোনা।
এন যে পি থেকে প্রায় সত্তর কিলোমিটার চক্কর কাটতে কাটতে যে জনপদটা এলো, তার নাম ঘুম। আর ঘুম মানেই…… ঘুম মানে যে কি কি নয়, সেই ফিরিস্তিটাই বড় বিশদ। কিন্তু ট্রাফিকের জেরে সেই বিহ্বলতাটা সহজেই কেটে গেল। দাঁড়াতেই পারলামনা। ফেরার সময় এ রাস্তা ধরেই যেতে হবে জেনে খানিক আশ্বস্ত হওয়া গেল তাও। আরও খানিক পাইন-পথ পেরোনোর পর পৌঁছোনো গেল একটেরে এক পাহাড়ের উপর একলা দাঁড়ানো সেই সবুজ রঙের বনবাংলোটায়। লেপচাজগৎ।
এখানে কিছু পূর্বকথন লিখে রাখি। জুন মাসে যখন জঙ্গলগুলো সব বন্ধ হবে হবে, তখনও একবার মনকেমন শুরু হয়েছিল। অনেক কি করি কি করি’র পর ঠিক করা গেল, তাহলে জঙ্গল যখন বন্ধই হয়ে যাচ্ছে, দুদিন একটু পাহাড়ে ঘুরে আসা যাক। সেই অনুযায়ী এক দিন লেপচাজগৎ আর একদিন তিঞ্চুলে তে বনবাংলো বুক করা হয়েছিল। এইবারে, লেপচাজগৎ সম্বন্ধে আমার আতঙ্কটা শুরু হয় বেশ কয়েক বছর আগে, যখন দিদিরা অনেকে মিলে ওখানে বেড়াতে যায়। যদ্দূর মনে পড়ছে, বাংলোটায় মোট পাঁচটা ঘর, নীচে দুটো স্যুইট, ক্যামেলিয়া, ম্যাগনোলিয়া। আর উপরে তিনটে, সেগুলোর কোনো নাম নেই। ওরা নীচের ঘর দুটো পেয়েছিল। বনবাংলো যেমন হয়, বিশাল বড় বড় ঘর, বাথরুম ইত্যাদি। তো, এবারে, মেন্ডি সেখানে রাত্রেবেলা, মানে এইই আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ বাথরুম গিয়ে কিছু একটা দেখেছিল, এবং বেদম পরিত্রাহি চিৎকার দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। পরের জন দিদি। সে’ও, বেসিনে মুখ ধুয়ে মুখটা ওঠাতে গিয়ে ওর মনে হয়েছিল আয়নার সামনে থেকে কোনো একটা ছায়া যেন সরে গেল। এরপর বাকি রাত ওদের কেমন কেটেছিল, পাঠক সেন্স করতে পারবেন, জানি। আরও যেটা সাংঘাতিক, ওখানকার রক্ষণাবেক্ষণ যে করে, কর্মা বলে ছেলেটি ও তার পরিবার, ওরা সারাদিন সন্ধ্যে অব্দি বাংলোতেই কাটায়। কিন্তু যেই সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত্রি হল, অম্নি ওরা সব কোয়ার্টারের পথে গনগনাগন গন টু গন নেভার কাম। তো, সেই লেপচাজগতে জুন মাসে আমাদের দুজনের যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেবার মাল জাংশানে নেমে এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আর ওদিকে এগোইনি। হ্যাঁ, ওইরকম অভিজ্ঞতা শোনার পর ওই বাংলোয় কেবলমাত্র গিরনকে সাথে নিয়ে একলা রাত কাটাতে আমি ভয় পেয়েছিলাম। সত্যি, ভয় পেয়েছিলাম।
কিন্তু এবারে দল ভারি। তার উপরে দলে আছেন আমার গ্রেট মাম্মি মাম্মি, যিনি আবার ভগবান বা ভূত, কোনোটাতেই বিশ্বাসী নন। মা’কে যদি আমি বলি, ওই অন্ধকারটায় যেতে ভয় করছে মা, সেই মুহূর্তে টানতে টানতে মা আমাকে ওই অন্ধকারেই নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দিয়েই ছাড়বে যে ওখানে ভয়ের কিছু নেই। অতএব……..
লেপচাজগতে পৌঁছে দেখলাম নভেম্বর মাসেই মারাত্মক ঠান্ডা। ঢোকার মুখে নীচের ঘরদুটোর দিকে একবার তাকিয়েই সোজা উপরে। কর্মা নাম ধাম সব লিখিয়ে নিয়ে গিয়ে ঘর দেখিয়ে দিল। সত্যি বলতে কি, দুটো ঘরই এত সুন্দর করে সাজানো, যে সব ভুলে গেলাম। কি সুন্দর দেখতে পর্দাগুলো। বাইরের দিকের গুলো নাইলনের জালের, তাতে সুন্দর ছোটো ছোটো আল্পনার মতন আঁকা ; আর ভিতরের পর্দাগুলো শাদা এবং ভারি, তাতে রঙবাহারি উল আর সুতো দিয়ে কাজ করা। ওরম পর্দা দেখেই মন ভালো হয়ে যায়। আর উপরি পাওনা, পর্দা সরিয়ে জানলা খুলতেই,,…….. এক্কেবারে জানলার বাইরেই তিনি….. যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে টুছিয়ে নাইতে গেনু। গিজার আছে, তবে ওই ঠান্ডায় সেও বিবশ। মানে কল থেকে বালতিতে পড়ার আগেই বরফ ঠান্ডা। সেই জল গায়ে ঢালতেই দম টা যেন আটকে এলো। মনে হল এবার হার্ট এ্যাটাকটা হয়েই সারবে। উদ্দামের মতন বালতি কয়েক ঢেলে ক্রিম ট্রিম মেখে বেরিয়েই সোজা মায়ের ঘরে, কারণ বাবা ততক্ষণে ওখানে হিটারের বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। ক্রিমের গপ্পোটা এখানে অকারণে করিনি, পাঠক অবিলম্বেই বুঝবেন। তারপর…….
লেপচাজগতের সেই বনবাংলোর। নীচের বাঁদিকের রুমটা ক্যামেলিয়া, আর তার ঠিক পিছনেই, ম্যাগনোলিয়া…… যেখানে…………..
এই পর্বে লেপচাজগতের সেই বনবাংলোটির ছবি রাখলাম।
লেখক : বর্ষা চক্রবর্তী 
barshaguria@gmail.com
এবং অরণ্য
ebongaranya@gmail.com
info@ebongaranya.com

8334998672 / 8013272494

Our YouTube channel

হৃদয়ের টানে – 3

তারপর…..
বাবাদের স্যুইটটা দেখলাম আরও বড়। সামনে একটা বসার ঘর, সেখানে ফায়ার প্লেসকে ঘিরে গোটা সাত আটেক সোফা ও চেয়ার। একপাশে ব্যালকনি, অন্য পাশে খারাপ হয়ে যাওয়া একটা টিভির স্মারক। যাঁর মহিমায় এই টিভিটি খারাপ হয়েছিল, তাঁকে মনে মনে বেশ ধন্যবাদ জানালাম। কারণ ওইরকম স্নিগ্ধতাকে খান খান করে সুমন দে বা হর্ষ ভোগলে, কাউকেই আমার সহ্য হতনা। আর সেই উন্মাদনাকে থামাতে আমার রাবণসম গলা ফাটানো, যে শুনেছে সেইই কেবলমাত্র জানে, কতটা বিভীষিকাময়!
ভিতরের ঘরটা বেডরুম, সঙ্গে বাথরুম অ্যাটাচড। এই স্যুইটটা বড় হলেও কাঞ্চন এখান থেকে সরাসরি দেখতে একটু বাঁধা পড়ে। হয়তো আগে হতনা, এখন একটা পাইন গাছ মাঝপথে নজর থামায়। হয়তো ওই কাঞ্চনের সাথে ওর অভিমান হয়ে থাকবে কোনো কারণে। আর বন্ধুরা তো জানেনই, অভিমান কেবল চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে একলা কোণে। পাহাড় আর নদীর প্রেমের গল্পটা তো আমরা সবাই শুনেছি। কিন্তু পাহাড়ের সাথে গাছেদের যে একটা সাংঘাতিক বন্ধুতা আছে, সেই দিকটা বোধয় কবিমন এড়িয়ে গেছিল। গাছেরা হল পাহাড়ের আজন্মকালীন বন্ধু। তেরা গম মেরা গম তেরি জান মেরি জান ওয়ালা দোস্তি যাকে বলে। ভেবে দেখলে দেখা যায়, একমাত্র এরাই বোধয় সেই বন্ধুতাটা রক্ষা করে গেছে সৃষ্টি থেকে অন্ত অব্দি। প্রতিটা পাহাড়ের ধ্বস বা ক্ষয় হল সেই বন্ধুবিচ্ছেদের প্রতিশোধমাত্র….
বাবা-মা’র স্নান হয়ে গেছিল। হাত পা সেঁকেই গেলাম গিরনকে তাড়া লাগাতে। বাথরুম, বিছানা আর নিজের অফিস, এই তিনটি তাঁর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। একবার ঢুকলে আর ততক্ষণ বেরোন না, যতক্ষণ না চেঁচাচ্ছি। ওদিকে পেটে তো ছুঁচো বীরবিক্রমে ওয়ার্ক আউট করছে। যাই হোক, সব পেরিয়ে আড়াইটা নাগাদ যখন ফাইনালি খাবার টেবিলে বসলাম, কর্মার বউ ধোঁয়া ওঠা ভাত, কোয়াশের একটা ঝোল ঝোল তরকারি, পিঁয়াজ ফোড়ন দেওয়া মুসুর ডাল, আলুভাজা, ডিমের ঝোল আর ঝাল ঝাল একটা আঁচার দিয়ে খেতে দিল। হাপুস হুপুস শব্দ – চারিদিক নিস্তব্ধ।
লাঞ্চ সেরে ছাদের দিকে পা বাড়ালাম। প্রচন্ড ঠান্ডা, আর ভাইরাল হাওয়াদের এড়িয়ে যখন ছাদের ফাঁকা জায়গাটায় পৌঁছেছি, মেঘ তার পরিবার পরিজনদের নিয়ে নামতে শুরু করেছে উপত্যকার দিকে। গোটা অঞ্চলটা মেঘে ঢেকে গেল মুহূর্তে। গতবার যখন কোলাখামে গেছিলাম, সেবারও এরকম সময়ে মেঘ ছেয়ে গেছিল চারপাশ। এমনি মেঘ বৃষ্টি বড়ই কাছের আমার। কিন্তু পরের দিন ভোরবেলার অনিশ্চয়তা রীতিমতন মুষড়ে দিল আমাকে। কর্মা বলল ‘কোই চিন্তা নহি ভাবিজি। পাহাড় কো তো আনা হি হোগা’। ওকে আর মহম্মদের গল্পটা বললামনা। আসলে এই মানুষগুলোও পর্বতের থেকে কিছুমাত্র কম শ্রদ্ধার নন। কর্মারা সারাদিন পরিশ্রম করে। বিশেষত পাহাড়ের মহিলারা…. কাঠ কাটা, রান্না করা, পশুপালন, সন্তান পালন, এসবের সাথে প্রকৃতির প্রিজার্ভেশন প্রক্রিয়াতেও ওঁরা বেশ সামিল। অথচ কোনো মালিন্য নেই। সত্যেরে লও সহজে-কে ওঁরা এতটাই সহজ ভাবে নিয়েছে…. দিনভর পরিশ্রমের পর ওঁদের রাত নেমে আসে সন্ধ্যে সাতটার এদিক ওদিক। কর্মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এত তাড়াতাড়ি ঘুমানোর অভ্যেস হয়ে গেছে বল তোমাদের..? খুব নির্বিকারে বলল নিন্দ থোরি হি আনে দেতে হ্যায়! হাম সব ঘর যানে কে বাদ ঝুমতে হ্যায়… লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, ফোন মে গানা লাগাকে আপস মে হি নাচা গানা লাগা রহতে হ্যায়। ভূমিকম্প, ধ্বস, বৃষ্টি… সবকিছুকে এই মনমউজি মানুষগুলো কি অবলীলায় পেরিয়ে যায় সময়ের সাথে সাথে… কি প্রখর ওঁদের প্রাণশক্তি।
ছাদ থেকে নেমে বাইরেটায় ঘুরতে গেলাম। শীত ফের ঠেলেঠুলে ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। ক্ষানিকক্ষণ কর্মার বউ আর ওর ছোট্ট ছানাটার সাথে বকবক করে কেটে গেল। দেখতে দেখতে লেপচাজগতে রাত নেমে এলো। সাতটা নাগাদ ওরা সবাই কোয়ার্টারে চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল, কোনোরকম প্রয়োজন হলেই যেন একবার ফোন করে ডাক দিই। পুরো সন্ধ্যেটা মা’র ঘরে কফি, চা আর হিটারের গরমে আর সুদেবদার সাথে গল্পে গল্পে কেটে গেল। ও, বলা হয়নি, কর্মা যাওয়ার আগে সুদেবদাকে নীচের ম্যাগনোলিয়া ঘরটা রাত কাটানোর জন্য খুলে দিয়ে যায়। সাড়ে নটা নাগাদ ডিনারের জন্য নীচে নামছি, দেখি কর্মার ভাই এসে হাজির। সুদেবদাই ফোনে ডেকে নিয়েছে। ও এসে আমাদের হাত ধোওয়ার আর খাওয়ার জল আলাদা আলাদা করে গরম করে দিল না চাইতেই। এতটা আতিথেয়তা, ভাবা যায়না। ভাবলাম শুধু এই জল গরম করার জন্য ও এতটা এলো ফের! কলের জলে হাত দিতেই বুঝলাম, কতটা আন্তরিক ওরা….
রাত্রিবেলা, ঘুম হলনা আমার। হ্যাঁ, আতঙ্কেই। জানলা দরজা ভালো করে সেঁটে পর্দা টেনেও কি একটা ভয় যেন রাত বাড়তেই গোটা ঘর জুড়ে চেপে বসলো ক্রমশ। রাত বাড়তেই হঠাৎ কেমন জানি গরম লাগতে শুরু করল। বাইরে ওইরকম বিষাক্ত ঠান্ডা, তাছাড়া শোয়ার আগে হিটারটাও বন্ধ করে দিয়েছিলাম, তাও, পৌনে বারোটা নাগাদ সেই যে আমার গরম করতে শুরু করল, সারারাত কেমন একটা উসপিস উসপিস ভাব…. আমি তো আমি কোন ছাড়, আগের দিন সারারাত ট্রেন জার্নি, এসবের পরেও গিরনও ঘুমালোনা। আবার ওই ঘরে বাবাও বলল ঘুম আসেনি শীতের ঠ্যালায়। বাবার ঘরে কিন্তু হিটার রাতভর জ্বলেছে।
কোনোরকমে পাখি ডাকা ক্ষণ অব্দি অপেক্ষা কাটিয়ে শেষে সাড়ে চারটে নাগাদ উঠে পড়লাম। আলোটা নিভিয়ে পর্দাটা সরিয়েছি, দেখি পুরো অন্ধকার। বড্ড মন খারাপ হয়ে গেল। কিছুই কি দেখতে পাবোনা শেষমেশ !!
লেখক : বর্ষা চক্রবর্তী 
barshaguria@gmail.com
এবং অরণ্য
ebongaranya@gmail.com
info@ebongaranya.com
Our website
8334998672 / 8013272494

Our YouTube channel

হৃদয়ের টানে – 4

তারপর….
আধঘন্টার মধ্যে আমাকে ভ্রান্ত-ভীরু-শহুরে এক মূর্খ প্রমাণ করে দুড়মুড় করে একদিকে উনি আলো ফেললেন…. এবং, অন্যদিকে তিনি জেগে উঠলেন। আর…. চোখে ঝিলমিল লেগে গেল….
আমাদের ঘরের সেই জানলাটাতেই তিনি একের পর এক খেলা দেখাতে শুরু করলেন…. ওই শেডকার্ডের বর্ণনা দেওয়ার চ্যালেঞ্জটা রঙ কোম্পানির হর্তাকর্তারা নিন, আমায় ক্ষমা দিন। আমি ভেতো হাভাইত্যা বাঙালি। তায় আবার রঙ দেখলে পাগলা হয়ে যাই। ক্যামেরাটা বিশ্রামে থাকলেও, থাকে তো আমারই সাথে। অতএব, ওইরকম সেলিব্রেশন দেখে সেও হাভাতেপনা লাগিয়ে দিল। একের পর এক মুহূর্ত তৈরি হল। বাবা, মা’কে নিয়ে এলো ওই ঘর থেকে। আমি বিছানার উপর দাঁড়িয়ে দেখলাম, জানলার সামনে আমার তিয়াত্তর বছরের বাবা তাঁর একচল্লিশ বছরের বন্ধুনীকে সঙ্গে নিয়ে কাঞ্চন দেখাচ্ছে….. মুহূর্তেরা মুহূর্তের কাছে ঋণী……
ছাদটাকে কথা দিয়েছিলাম, খুব শীত করলেও ওর কাছে ভোরবেলা ফিরবোই ফিরবো। কথা রাখতে গুটি গুটি এগোলাম। পাহাড়, আকাশ বড় মাঠ আর এই পৃথিবীটা, যখন টের পাইয়ে দেয় ‘বৃহৎ’ শব্দের অস্তিত্ব, তখন সামনে দাঁড়ানো সেই ক্ষুদ্রের ভিতরটুকুও যেন খুব বড় হয়ে যায়…. অনুরণন সিনেমাটার শেষের দিকের সেই দৃশ্যটা, যেখানে রাহুল গিয়ে ব’সে ওই পাহাড়ের কাছে…. রাহুল কেন গেছিল..? কেন আমি গেলাম..? হাইওয়ে’র মীরা ত্রিপাঠি সেই পাথর পেরিয়ে নদীর উপর আরেকটা পাথরে যখন গিয়ে বসলো, ও হাসলো, হাসতে হাসতেই কেঁদেও ফেললো…. কেন!! খামোখা কেমন যেন মন আর মন সর্বস্ব একটা কুসুমে পরিণত হয় রুহ্ টা….
সারা সকাল ছবি তুলে আর কর্মার মেয়ের সাথে বকবক করে কাটলো। তারই মাঝে অবশ্য এক ভিনদেশি পাখিদের ডাকপিওন এসে নাচগান শুনিয়ে গেছেন আমাদের। উনি আবার খুব ক্যামেরা-শাই প্রকৃতির। অনেক চেষ্টায় নানানরকম গল্পটল্প বলে, তার পরিযায়ীদের রাহানসাহান জানানোর পর তিনি রাজী হলেন দু-একখানা ছবি তুলতে দিতে। তারপরেই ফের ‘আমার কাজ আছে গো, সারাদিন তোমাদের সাথে খেজুর করতে পারিনা’ বলে চলে গেলেন অন্য ফুলের বাড়ি…. আর পাহাড় তো ফুলেদেরই বাড়ি।
সকালবেলা লুচি, হলুদ ছাড়া শাদা রঙের আলুর তরকারি আর সুদেবদা’র আনা সন্দেশ দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারা হল। এবার প্যাকিং এর পালা। লেপচাজগৎকে বিদায় জানানোরও।
এইবার আসি সেই ক্রিমের গল্পটায়। নর্মালি কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগে, ক্রিম, শ্যাম্পু, স্ক্রাবার বা ফেসওয়াশ, সবেরই ছোটো প্যাকগুলো কিনে সেগুলো আলাদা প্লাস্টিকে ভরে একটি অ্যাকসেসরিজ ব্যাগেই ভরে থাকি। এবারও তাই করেছিলাম। আগেরদিন স্নানের সময় এক্কেবারে নতুন প্যাকগুলো আনপ্যাক করেছিলাম। কিন্তু……….. গোছানোর সময় বাথরুম থেকে বের করতে গিয়ে দেখলাম, ক্রিম, শ্যাম্পু, ফেসওয়াশ এবং স্ক্রাবার, সবকটির বোতল প্রায় পঁচাত্তর ভাগ শূন্য। অথচ নতুন প্যাক ছিল। গিরনকে জিজ্ঞেস করার কোনো মানেই নেই কারণ ওর অ্যাক্সেসরিজ সম্পূর্ণ আলাদা, ও আমারগুলো কোনোদিন ব্যবহার করেনা। তাও জিজ্ঞেস করলাম, ন্যাচারালি, নেগেটিভ অ্যান্সার। মন বোঝাতে ধরেও নিলাম, গিরন ক্রিম মেখেছে, নাহয় একটু ফেসওয়াশ দিয়ে ক্লিনও করেছে…. কিন্তু স্ক্রাবার!! ও তো ওটার ইউসেজই জানেনা। প্লাস্টিক, ব্যাগ, যেখানে রেখেছিলাম তাকগুলো ভালো করে খুঁজেও কোথাও এক ফোঁটাও গড়িয়ে পড়ার চিহ্নমাত্রও পাওয়া গেলনা। তাহলে……!! এটা ছিল প্রথম ভয়…..
দ্বিতীয়টা হল নীচে নেমে। মা’কে ঘটনাটা বলছি, সামনে সুদেবদাও ছিল। মা যথারীতি উড়িয়েই দিল…. সুদেবদা তখন বলল, ‘বৌদি, তুমি ভয় পাবা দিইখ্যা আমি ভোরে কিছু কইনাই, তয়, কাল রাত্রে আমার ঘরেও একখান ঘটনা ঘটছে, আমার অজান্তেই’। আমার মুখে আর আওয়াজ নেই। ও’ই বলতে শুরু করল, ‘কাল দুইটা কম্বল গায় দিয়া শুইছিলাম। ভোরে উইঠ্যা দেখি একখান গায়ে আছে.. আরেকখান নাই। অনেক খুইজ্যাও পাইনাই’। কর্মাকে ডাকলাম। অনেকেই যে এই বাংলোতে নানাবিধ অভিজ্ঞতা পেয়েছেন এবং আমরাও বঞ্চিত হলামনা, এইসব জানানোর পর সরাসরি যখন কর্মাকে বললাম, বলতো কর্মা, এই বাংলোতে কিছু আছে…? কর্মা চুপ। মাথা নীচু। হাসলোও না।
শোনা যায়…. পুরোনো চৌকিদার, যে অনেক কাল আগে মারা গেছে……………………
লেপচাজগৎ থেকে ফেরার পথে সেই ঘুম স্টেশন…. এবারও ট্রাফিক… খানিকটা এগিয়েই দেখা গেল ঘুম পাহাড়। পেরিয়ে চললাম।
তারপর……..
লেখক : বর্ষা চক্রবর্তী 
barshaguria@gmail.com

এবং অরণ্য

ebongaranya@gmail.com

Our Youtube channel

হৃদয়ের টানে – 5

তারপর….
অনেকগুলো পাতা তুলে নেওয়া চা গাছের ভিতর দিয়ে আঁক কাটতে কাটতে, ঘুরতে ফিরতে আমরা চলে চললাম তিনচুলের দিকে। কাঞ্চনজঙ্ঘা আরও দুই বন্ধুনী বা বলা যায় বন্ধনী সহযোগে ওই উপত্যকার সামনেই বিরাজ করছেন বলেই হয়তো ওরম নাম জায়গাটার। যাওয়ার পথে এক জায়গায় গাড়ি আটকালো। একটি গোর্খা পরিবারে বিয়ের অনুষ্ঠান। হয় বর বিয়ে করতে যাচ্ছে, বা বিয়ের পর বউ ঘরে আসছে, এরকম কিছু একটা প্রণালি চলছিল তখন। একজন কর্তা মতন মানুষ, তিনি বরের না কন্যার, বোঝা হয়নি, এসে খুব বাবার মতন করে হেসে বললেন আমরা যেন অল্প খানিকক্ষণ অপেক্ষা করি, ওঁদের গাড়ি বেরিয়ে গেলেই আমরা আমাদের পথে উঠতে পারবো। তো, পথপাশে দাঁড়ানো গেল। সামনে একটা বাড়ি, বাড়ির নীচে মনোহারি দোকান, ওই প্রত্যন্ত পাহাড়ে সব পাওয়ার যেমন দোকান হয়, তেমনই। বাড়িটার বারান্দায় আর ছাদে রাশি রাশি সবজে লাল স্ট্রবেরি ফলে আছে। আমাদের অপেক্ষমান ট্যোরিস্ট বুঝে বাড়ির মালকিন দিদি ঝপাঝপ এক মুঠো প্রায় পেকে যাওয়া স্ট্রবেরি নিয়ে নেমে এসে হাতে ধরিয়ে গল্প করতে শুরু করলেন। স্ট্রবেরি খাওয়া কষাটে দাঁতে বকবক করতে করতে মনে হল, পাড়ায় যখন নতুন বউ বা বর আসে, তখন পথচলতির সাহায্যে অযাচিতভাবে এর কণামাত্রও কিছু করেছি কোনোদিন?
কাঞ্চন যথারীতি তিনচুলের পথেও পিছু ছাড়েনি। ছাড়ার কথাও ছিলনা। আমি বুর্বাক তাই….. তো বুর্বাক দেখলে ম্যাজিশিয়ানরা আরও বেশি বেশি ভেলকি দেখান। সেইরকম কিছু কাঞ্চন-ভেলকি দেখার জন্য প্রায় পৌঁছে যাওয়া তিঞ্চুলের কাছে এক জায়গায় দাঁড়ানো হল। আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলো যে শিরোনামে মিলেছে, প্রায় সেরকম একটা জায়গা, মনাস্টারি নেই, কিন্তু অতটাই শান্ত, শিরশিরে হাওয়াদের একটা জায়গা। একটা বসার সিমেন্ট বেঞ্চ, অনেকগুলো সেই তিব্বতি পতাকার মতন, সার সার দিয়ে পরের পাহাড়টায় উঠে গেছে একে একে। আর প্রত্যেকটা স্তম্ভের ভিতর দিয়ে যেন কুমারি আর কিশোর হাওয়াদের দল ঘুরে ঘুরে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে। কখন আমাদেরও ছুঁয়ে গেল ওরা….
মুখ ফিরাতে বাবাকে দেখলাম। পিছন জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা হিমালয়, তার সামনে আমার বাবা, আমার হিমালয়….. বাবা ঠিক কখনও তেমন জানান দেয়না, অথচ সে ঠিক ওইখানেই, বনস্পতির মতন…।
তিঞ্চুলে দিনের বেলা একটা ফুল, ফল আর সব্জির বাগান, আর রাত্রে ভোল বদলে পুরো একটা রূপকথা। ফরেস্ট ডেভেলাপমেন্টের সাথে টাই আপ হওয়া একটা হোমস্টে, আমাদের রাতের আস্তানা। হলুদ রঙের বাড়িটার যেদিকে তাকানো যায়, সবুজ খাতার পাতার উপর বাহারি রঙ ছেটানো বিন্দুর মেলা। কেবল ফুল আর ফুল। ধাপে ধাপে ওঠা পাহাড়ের ভিতর ঘর, আর ঘরের বাইরে ছাদের খানিক খোলা জায়গা। সেই ছাদ থেকে উল্টোদিকের উপত্যকায় নাথুলা, জুলুক, আরিটারের একের পর এক নিদর্শন। যাঁর হোমস্টে, তিনি, একজন এক্স ইন্ডিয়ান আর্মি, এসে গোটা উপত্যকাটা এক এক করে চিনিয়ে দিলেন। ঘরগুলো একটু ছোটো ছোটো, কিন্তু শাদা আর লাল রঙের হাফ আর ফুল পর্দা দিয়ে কি সুন্দর করে সাজানো…। আমরা বেশ তাড়াতাড়িই পৌঁছেছিলাম, তাই লাঞ্চের আগে এক দফা ঘুরে আসবো ঠিক করলাম জায়গাটা….
ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গেলাম একটা কমলালেবুর বাগানে। কাশ্মীরে আপেল দেখে যেমন হাভাইত্যায় ধরেছিল, এখানেও ঠিক তাই হওয়ার ছিল। কিন্তু, বয়সটা বেড়েছে, আর মা বাবার সাথে থাকলে খজরামো করার সাহসটা এখনো ঠিক গজায়না। তাই, ওইরকম প্যারাডাইস অফ অরেঞ্জ থেকে মাত্র তিনখানা কমলালেবু পকেটে সাঁটিয়েই অগত্যা বিদায় নিলাম। আসার সময় দু জায়গায় রাস্তার ধারে পাহাড়ি কুমড়ো আর খুব পাকা পাকা স্কোয়াশ দেখেছিলাম। প্রতিজ্ঞা করলাম, ওগুলোর দফারফা ফেরার পথে করবোই করব। যথারীতি, মা বাবার ‘ওরে তুলিসনা’, ‘ওরে যাসনা’, গিরনের ‘আমি কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে যাবো’ এসব বাণী অগ্রাহ্য করে আমি, আর আমার কমান্ডার সুদেব বসাক কুমড়ো, স্কোয়াশ ইত্যাদি ফসল কেটে ঘরে ফিরলাম। ও হ্যাঁ, তিঞ্চুলে ঢোকার আগে এক জায়গায় দারুণ টাটকা মূলো আর গাজর বিক্রি হচ্ছিল, সেগুলোও নিয়েছিলাম। ঘরে এসে দাজুকে বললাম ‘ইয়ে সব সবজি মিলাকে রাত মে কুছ পকাইয়ে, মিলকে খায়েঙ্গে’। রাত্রের সব্জিটা সত্যিই অনন্য হয়েছিল। সিম্পল পাঁচফোড়ন দেওয়া একটা ঝোল ঝোল তরকারি, কি যে সুন্দর খেতে….. গিরন তখন অত লম্ফঝম্প করলেও, খাওয়ার সময় দিব্য চেটেপুটে খেলো দেখলাম।
খেয়ে যখন ঘরে ফিরছি, সেই রূপকথাটা শুরু হল। অন্ধকার তিঞ্চুলের ছাদ থেকে দেখা গেল, ওপারে বিস্তীর্ণ পাহাড়ে কোটিখানেক আলো জ্বলেছে। অন্ধকারে এত আলোর বিন্দু আগে কখনো দেখিনি ভেবেছি যেই, আকাশে তাকিয়ে দেখি গোটা সৌরজগতটাই যেন মাথার ঠিক উপরটায় নেমে এসেছে…… এত তারা….. এতও তারা…… ‘রাতের সব তারাই আছে’ যেন রাতেরই অন্ধকারে…… বোবায় ধরল আমায়….. আমি মাথা উঁচু করে প্রণত হলাম….. “…বারবার আসি আমরা দুজন বারবার ফিরে যাই / আবার আসবো আবার বলবো শুধু তোমাকেই চাই…”
লেখক : বর্ষা চক্রবর্তী 
barshaguria@gmail.com
                                               এবং অরণ্য
8334998672

No comments:

Post a Comment